শীতলক্ষ্যার তীরে বরমী: সৈনিক, শিল্পী আর কৃষকের মিলনভূমি
হুমায়ুন কবির চৌধুরী, গাজীপুর থেকে
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়ন—এ যেন ইতিহাস, কৃষি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই জনপদে আছে শত বছরের বাজার, পুরনো সৈনিকদের স্মৃতি, লোকশিল্পের রথযাত্রা আর কৃষক-জেলেদের প্রতিদিনের সংগ্রাম। বরমী একদিকে যেমন প্রাচীন, তেমনি আধুনিক স্পর্শে নবজীবন লাভ করছে।
—
সোয়া চার শ বছরের বরমী: বার্মা থেকে বরমী নামকরণের ইতিহাস
প্রায় ৪১৯ বছর আগে মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা) থেকে জলদস্যুরা শীতলক্ষ্যা নদী বেয়ে বাংলায় লুটপাটে নামে। মোগল সেনারা তাদের ধরতে শ্রীপুর অঞ্চলে অবস্থান নেয়। বরমী এলাকায় এক সপ্তাহ ধরে সংঘর্ষ চলে, আর এখানেই জলদস্যুরা আটকা পড়ে। এই ঘটনা থেকেই জায়গার নাম হয় ‘বরমী’। পরে এখানে গড়ে ওঠে বরমী বাজার, যা কালক্রমে বিশাল আকার ধারণ করে।
—
বরমী বাজার: এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন গ্রামীণ হাট
বরমী বাজারের খ্যাতি বহু পুরোনো। শোনা যায়, এটি একসময় এশিয়ার সবচেয়ে বড় গ্রামীণ বাজার ছিল। এখনো এটি পৌর বা উপজেলা শহরে রূপান্তরিত না হয়ে গ্রামীণ রূপেই টিকে আছে। হাটবারের সকালগুলো এখানে যেন উৎসব—ধান, পাট, কাঠ, মাছ, গরু-ছাগলের হাটে সরগরম থাকে পুরো এলাকা।
বরমী বাজারের এক বড় বৈশিষ্ট্য তাল কাঠের আড়ত ও শতাধিক কামারপট্টি। আশপাশের জেলেরা এখান থেকেই মাছ ধরার জাল কিনে থাকেন। এখানে রয়েছে অর্ধশতাধিক চালকল ও একটি বড় মাছের আড়ত, যা সড়ক ও নৌপথে দেশের বিভিন্ন জেলায় চাল সরবরাহ করে।
প্রবীণ ব্যবসায়ী সুদীপ্ত কর্মকারের পরিবার এখানে তিন পুরুষ ধরে ব্যবসা করছেন। রবীন্দ্র কুমার ও অহিদুল হক ভূঁইয়ারাও জানান, এ বাজারের ঐতিহ্য ও বানরের সঙ্গী হওয়ার অভিজ্ঞতা দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে।
—
বানর আর মানুষের সহাবস্থান: বরমীর অনন্য বৈশিষ্ট্য
বরমী বাজারের অলিগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে হাজারো বানর। খাবার চেয়ে এরা দোকানে ঢুকে পড়ে, আবার কখনো মানুষদের কোলে বসে খেলা করে। বাজারে যাওয়া শিশু-কিশোরদের বড় আকর্ষণ এই বানররাই। শ্রীপুর উপজেলা প্রশাসন তাদের রক্ষা ও সুরক্ষায় নানা উদ্যোগ নিচ্ছে।
—
সৈনিকের জনপদ বরমী
বরমীর আরেকটি পরিচয় হলো এটি একটি সৈনিক গড়ার জনপদ। মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে সেনা, আনসার, বিজিবি—সব বাহিনীতে এখানকার তরুণদের সরব উপস্থিতি রয়েছে। অনেকে অবসরে এসে গ্রামের স্কুল-কলেজে শিক্ষাদান বা কারিগরি প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
—
শিল্প ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র
বরমী ইউনিয়নে লোকসংগীত, পালাগান, বাঁশির ঐতিহ্য এখনও টিকে আছে। ‘রেহানা শিল্প একাডেমি’ ও ‘বরমী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ স্থানীয় শিল্পীদের তৈরি মঞ্চ। নতুন প্রজন্ম ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গান, নাটক ও কন্টেন্ট তৈরি করে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত হচ্ছে।
—
কৃষির প্রাণ বরমীর মাঠে
শীতলক্ষ্যার পলিমাটি বরমীর বিস্তৃত মাঠে ফলায় ধান, সরিষা, সবজি, কলা আর ফুল। কৃষক মতিউর রহমান বলেন, “আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম আর সংরক্ষণব্যবস্থা থাকলে বরমী কৃষিতে আরও এগিয়ে যেত।”
—
বরমী খেয়াঘাট: নৌবাণিজ্যের দরজা
শীতলক্ষ্যার তীরঘেঁষা বরমী খেয়াঘাট একসময় ছিল নৌবাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। এখনও অনেক মানুষ নদীপথে যাতায়াত করে। কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়নের অভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বর্ষায় পাড় ধসে পড়ে যাত্রীদের চলাচল ব্যাহত হয়।
—
ইসলামী মহাসমাবেশ: দ্বিতীয় বৃহত্তম আয়োজন
বরমীতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় গাজীপুর জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামী মাহফিল—‘বন মাহফিল’। এটি বরমী ইউনিয়নের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে অনন্য গুরুত্ব বহন করে।
—
অজানা ইতিহাস: গোলাঘাট বাজার ও কর্ণপুর দিঘী
গোলাঘাট বাজার এবং কর্ণপুর বড় দিঘী এলাকার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রাচীন রাজ্য কনক রাজার ইতিহাস জড়িত, যদিও সেসব তথ্য এখনও গবেষণার অপেক্ষায়। স্থানীয়দের দাবি, এগুলো সংরক্ষণ করলে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে তোলা সম্ভব।
—
উপসংহার
বরমী ইউনিয়ন শুধুই একটি জায়গা নয়—এটি ইতিহাস, সাহস, শিল্প, ব্যবসা ও কৃষির অনন্য সম্মিলন। বরমীকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুললে এটি হতে পারে গাজীপুর জেলার একটি মডেল ইউনিয়ন এবং একটি জাতীয় সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র।