রিপন মিয়া: কাঠমিস্ত্রির হাত থেকে উঠে আসা এক ‘বাস্তব’ কনটেন্ট জাদুকর
লেখা: হুমায়ুন কবির চৌধুরী
নেত্রকোনার এক অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে এসে, ইউটিউব ও ফেসবুকের পর্দায় যিনি দেশের লাখো মানুষের মন জয় করেছেন, তার নাম রিপন মিয়া। পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি হলেও, রিপন এখন কেবল একজন নির্মাণশ্রমিক নন, বরং হয়ে উঠেছেন বাস্তব জীবনের কনটেন্ট নির্মাণে এক অনন্য নাম।
এক হৃদয়ভাঙা গল্প থেকে যাত্রা শুরু
২০১৬ সাল। কৈশোরে এক প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যায় রিপনের। অনেকেই এমন পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়েন, কেউ কেউ আত্মবিনাশের পথে হাঁটেন। কিন্তু রিপন সেই কষ্টকে রূপ দেন সৃজনশীলতার। মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়ে বানানো ছন্দে ছন্দে কথা বলা একাধিক ‘ক্রিঞ্জ’ ভিডিও দিয়েই তার যাত্রা শুরু।
প্রথম ভিডিওতেই তিনি বলেন,
“বন্ধু তুমি একা হলে আমায় দিও ডাক,
তোমার সঙ্গে গল্প করব আমি সারারাত।”
শেষে তার হাসিমাখা মুখে সেই বিখ্যাত বাক্য: “আই লাভ ইউ”।
বাস্তবতার মুখোমুখি দর্শক
রিপনের ভিডিওতে নেই কোনো আলোকসজ্জা, নেই জাঁকজমক, নেই অভিনয়ের পরিপাটি ভাব। তিনি যা করেন, সেটাই দেখান—সাইকেল চালিয়ে কাজে যাওয়া, গরমে ঘাম ঝরিয়ে কাঠ কাটা, নিজের রান্না নিজে করা, কিংবা গ্রামীণ জীবনের সাধারণ ঘটনা তুলে ধরা।
একটি ভিডিওতে তাকে গরমে রান্না করতে দেখা যায়। আঞ্চলিক ভাষায় বলেন,
“মা-বোনেরা এমন কষ্ট করে রান্না করেন, অথচ আমরা তা বুঝি না।”
এভাবেই তার ভিডিওগুলো হয়ে ওঠে সমাজের অবহেলিত বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
দর্শকের ভালোবাসায় বড় হয়ে ওঠা
তার হাস্যরস, সরলতা আর নিজস্ব ঢঙে বলা বাক্যগুলো অল্প সময়ে ভাইরাল হয়ে পড়ে। আজ তার ফেসবুকে ‘খাদক রিপন’ ও ‘রিপন মিয়া’ নামে দুটি পেজে মিলিয়নের বেশি ফলোয়ার। ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক—সব প্ল্যাটফর্মেই তিনি জনপ্রিয়।
সংগ্রাম ও পুনর্জাগরণ
দু-একবার হ্যাক হয়ে গেছে তার পেজ ও চ্যানেল। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। একসময় ভিডিও বন্ধ করে পুরোপুরি কাঠমিস্ত্রির জীবনেই ফিরে যান।
তবু হাল ছাড়েননি। এক মিডিয়া ম্যানেজারের সহায়তায় আবারও ফিরে আসেন নতুন উদ্যমে। এখন তিনি নিয়মিত কনটেন্ট বানান এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে আয়ও করছেন।
একজন ‘বাস্তববাদী’ কনটেন্ট নির্মাতা
রিপন বলেন,
“যারা চাকরি খুঁজে পায় না, তারা আমার সাথে কাজ শিখুক। দিনে ৫০০-৬০০ টাকা আয় হবে—এটাই বাস্তব।”
তার ভিডিও এখন শুধু হাস্যরস নয়, বরং জীবনের প্রতিচ্ছবিও।
শেষ কথা
রিপন মিয়া প্রমাণ করেছেন—প্রযুক্তির এই যুগে গ্রামের এক সাদাসিধে কাঠমিস্ত্রিও যদি আন্তরিকতা, সৃজনশীলতা আর বাস্তব জীবনের গল্প দিয়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারেন, তবে সম্ভব সব কিছুই।
রিপনের গল্প তাই শুধু ভাইরাল কনটেন্টের গল্প নয়, এটা একজন সংগ্রামী মানুষের বাস্তবতা, আবেগ, সাহস আর নীরব বিপ্লবের কাহিনি।