সাইফুল ইসলাম ফয়সাল
গতকাল নগরীর কান্দিরপাড়ে বীরচন্দ্র পাঠাগারের মুক্তিযুদ্ধ কর্ণারে কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুলের উদ্যোগে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কুমিল্লা জেলা কমান্ড কর্তৃক আয়োজিত স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদ কর্তৃক প্রহসনের বি চারে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হ্ত্যা করায় তাদের স্মরণে স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮১ সালের ২৩ ও ৩০ সেপ্টেম্বর ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ফাসির মাধ্যমে এবং ২জন মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করায় স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদের মরণোত্তর শাস্তির দাবী করেন উক্ত সভার সকল অতিথিবৃন্দ । যে সকল বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়েছিল তারা হলেন- মেজর জেনা. আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম, বিগ্রেডিয়ার মহসীন উদ্দিন বীর বিক্রম, কর্নেল নওয়াজেশ উদ্দিন, কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ বীরপ্রতীক, লে. কর্নেল মাহবুবুর রহমান বীর উত্তম, লে. কর্নেল এটিএম মাহফুজুর রহমান বীর বিক্রম, লে. কর্নেল দেলোয়ার হোসেন বীরবিক্রম, মেজর এ.জেড গিয়াসউদ্দিন আহমদ, মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঁইয়া বীরপ্রতীক, মেজর কাজী মমিনুল হক, মেজর মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান, ক্যাপ্টেন আব্দুস সাত্তার, ক্যাপ্টেন জামিল হক, লেফটেন্যান্ট রফিকুল হাসান খান এবং লে. কর্নেল শাহ মোহাম্মদ ফজলে হোসেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বীরমুক্তিযোদ্ধা বাহার উদ্দিন রেজা বীরপ্রতিক বলেন, বিচার ছিল জাস্ট একটা সাজানো, দেখানো, সিদ্ধান্ত তারা আগেই নিয়ে নিয়েছিল। সিদ্ধান্ত তাদের বিপক্ষেই নেওয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে যাদেরকে তারা বাধা মনে করেছিল। সুতরাং তাদের টার্গেট ছিল কেবল মুক্তিযোদ্ধারা। ওই মামলায় যাদের সাক্ষী নেওয়া হয়েছিল তাদেরকে জোর করে তা আদায় করা হয়েছিল। অনেকের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন সাক্ষীও ছিল না তবুও তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। যাদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের সবার সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও অনেককেই আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি। মেজর রওশন ইয়াজদানী এতটাই সৎ ছিলেন যে তার বিরুদ্ধে কখনও কেউ অভিযোগ আনতে পারেনি। জেনারেল মঞ্জুর সাথে মাঝেমধ্যেই আমার কথা হতো। তিনি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। কারা কীভাবে গুলি করে, সেটা নিয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। আরও অন্যান্য যাদেরকে ফাসি দেওয়া হয়েছে তাদের সাথে আমি জেলে গিয়ে দেখা করতাম খোজখবর নিতাম। মেজর ইয়াজদানী ছিলেন ক্যাপ্টেন রেজা ভাইয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ । তিনি আরও বলেন, সরকার মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রতিমাসে ২০ হাজার করে সম্মানীভাতা দিচ্ছে। অথচ বিএনপি জামাত মাথাপিছু স্বল্প টাকা খরচ করেই বিভিন্ন এলাকায় মিটিং মিছিল এবং বিভিন্ন কর্মসূচীতে মানুষ ভাড়া করছে। আমাদের জন্য এটা লজ্জার বিষয়। প্রত্যেকটা এলাকাতে যদি একজন মুক্তিযোদ্ধাও এসব মিটিং মিছিলে বাধা প্রদান করতো তাহলে তারা এতটা তৎপরতা চালাতে পারতো না। আগামীতে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিএনপি-জামাত এবং এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান তিনি।
সভার সভাপতির বক্তব্যে কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল বলেন, এরশাদ ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা অফিসার। তিনি কোনভাবেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন না। ১৯৭১ সালের শুরুতে এরশাদ ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। রংপুর হয়ে তিনি পাকিস্তানে ফিরে যান। ১৯৭১ এর মার্চ এপ্রিলের পর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চেয়েছিলেন এবং যারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহায়তা করতে রাজি হননি তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী হিসেবে গ্রেফতার হচ্ছিলেন। সামরিক আদালতে এদের বিচার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন জেনারেল এরশাদ। আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যায় সবচেয়ে লাভবান ব্যক্তি হচ্ছেন জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ। জিয়া হত্যার পর বিদ্রোহের দায়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে প্রহসনের গোপন বিচারে ১৩ সামরিক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে ঘাতক সর্দার জেনারেল এরশাদ। জিয়া হত্যার পর ঠান্ডা মাথার খুনি এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেননি। হত্যার পর পর এরশাদ ক্ষমতা নিলে দেশ-বিদেশের সবাই বলত এরশাদই খুনি। যেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আসল খুনি জিয়াকে রাষ্ট্রপতি করা হয়নি। জিয়া হত্যার পর ওই সময় বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও পরে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি থাকলেও ক্ষমতার দণ্ড ছিল সেনাপ্রধান এরশাদের হাতে। মুক্তিযোদ্ধা নিধনের যে নীল নকশা বাস্তবায়ন চলছিল তারই অংশ হিসেবে কোন ধরনের দোষ বা সম্পৃক্ততা না থাকার পরেও কেবল মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণেই অন্যায়ভাবে ওই মুক্তিযোদ্ধাদের দণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং বিচারটি ছিল সাজানো নাটক। রায় আগেই তৈরি ছিল। তাই কোন ধরনের আইন-কানুন বা নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে টার্গেট করা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁসি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর থেকে সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধা নিধনের যে নীল নকশা বাস্তবায়ন চলছিল এ ঘটনা ছিল তারই অংশ বলে বক্তারা দাবী করেন কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল। সভায় আরও বক্তব্য রাখেন কুমিল্লা জেলা কমান্ডের সাংগঠনিক কমান্ডার জাহিদ হাসান, কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার কমান্ডার শাহজাহান সাজু, ইউনিয়ন কমান্ডার সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার মোঃ ইদ্রিছ, নুরুল ইসলাম সিদ্দিকী সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ। সভা উপস্থাপনা করেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের আহ্বায়ক মাসুম হামীদ। এতে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।